– এই যে মাঠ দেখছিস, গড়পড়তা এটি ১২০ মিটার বাই ৯০ মিটার হয়। সবুজ হতে হবে মাঠ, বুঝলি? ঐ যে দুই পাশে সাদা বাক্সের মতো দেখছিস, ওগুলোকে গোলপোস্ট বলে, ওটা থেকে ৬ ইয়ার্ড ও ১৮ ইয়ার্ড দূরে দুটো সাদা বাক্স আঁকা। মাঠের মাঝখানে দেখ, একটা গোল্লা আঁকা। খেলা মোট ৯০ মিনিটের হয়, ৪৫ মিনিট পরে একটা ব্রেক। প্রতি দলে খেলোয়াড় লাগে ১১ জন, এর মধ্যে ১ জন গোলকীপার। খেলোয়ারদের কাজ হলো অপর গোলপোস্টের জালে বলটাকে জড়িয়ে দেওয়া। তারপর নাদনকোদন করে গোল উদযাপন। এটাই হলো ফুটবল। তবে সাবধান, ফাউল বা অফসাইড করা যাবে না। তাহলে মাশুল দিতে হবে, বুঝলি।
– হুম, বুঝলাম। তো এই খেলাটা বানালো কে?
– কেউ বানায় নি!
– মানে!! ফাজলামো করছিস?!
– নাহ! ফাজলামো করবো কেন? শোন, যেহেতু ফুটবল খেলার জন্য নিয়ম বা সূত্র আছে, সুতরাং ফুটবল খেলা নিজেকে শূন্যতা থেকে সৃষ্টি করতে পারে।
– মাথা ঠিক আছে তো?
গল্পের ১ম জনের ব্যাখ্যা শুনে আমার-আপনার অভিব্যক্তি ২য় জনের সাথে পুরোপুরি না মিললেও খুব একটা ভিন্ন হবে না। আপনি হয়তো বলবেন, কিরে, মাথা-টাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো?
তো কেন এমন অভিব্যক্তি?
কারণটা সহজ, আমরা সবাই জানি সূত্র কোনো স্বতন্ত্র-স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্ত্বা নয়। এগুলো হলো কিছু প্যাটার্ন, কমন সেন্স বলে এগুলো কোনো বুদ্ধিমত্তার দিকে ইঙ্গিত করে। The Divine Lawmaker: Lectures on Induction, Laws of Nature and the Existence of God-গ্রন্থে অক্সফোর্ডের দার্শনিক জন ফস্টার যুক্তি দেখিয়েছেন প্রকৃতির এই নানাবিধ সূত্রগুলোর সর্বোত্তম ব্যাখ্যা হলো ঐশ্বরিক বুদ্ধিমত্তা। সূত্র আছে তাই হাওয়া থেকে কোনো কিছু হয়ে গেছে এমন গাঁজাখুরি ব্যাখ্যা কোনো সুস্থ মানুষ মানবে না। তবে হ্যাঁ, কোনো বিখ্যাত বিজ্ঞানী যদি বলে? তাহলে মানবে কি?
তো হঠাৎ এমন কথা কেনো জুড়ে দিলাম বলুন তো। লেখার শিরোনাম দেখে ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন লেখাটার সাথে প্রয়াত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ নাস্তিক স্টিফেন হকিং এর কোনো না কোন কানেকশান আছে। তো কি সেই কানেকশান? একটু খুলেই বলি কেমন? স্টিফেন হকিং তার A Brief History of Time গ্রন্থ লিখে একসময় বেশ নজরে আসেন। নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও এই বইতে তিনি এমন কিছু উক্তি করেন যা আস্তিকতার পক্ষে যথেষ্ট ইঙ্গিত বহনকারী। যেমন মহাবিশ্বের অভূতপুর্ব ডিজাইন ও সমন্বয় দেখে তিনি বলেছিলেন:
“মহাবিশ্বের সূচনা ঠিক এমন (মাপা) কেন হলো সেটার ব্যাখ্যা দিতে চাইলে – এটি এক স্রষ্টার কাজ যিনি আমাদের মতো সত্ত্বাকে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, এমন ব্যাখ্যা দেওয়া ছাড়া অন্য কোনোভাবে এই সমন্বয়ের সুরাহা করা খুবই কঠিন।” [1]
সেই তিনিই আবার মরার আগে আরেক বই লিখলেন The Grand Design শিরোনামে। এই বইতে এসে তিনি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলেন। আমাদের ফুটবল গল্পের প্রথম চরিত্রের মত উদ্ভট কথা বলে বসলেন! বুড়ো বয়সে এ কী খেয়ালে পেয়ে বসলো তাকে! তো, কি বললেন তিনি? তিনি বললেন:
“যেহেতু মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের মতো পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র রয়েছে, (তাই) মহাবিশ্ব নিজেকে শূন্যতা থেকে সৃষ্টি করতে পারে এবং তা করবেও।” [2]
ব্যস, কেল্লাফতে। নাস্তিক-মুক্তমনা সম্প্রদায় তো মহা খুশি। নবী (!) বলেছে মহাবিশ্ব শূন্য থেকে সৃষ্ট হতে পারে! আর কী লাগে! কিন্তু তারা একবারও ভেবে দেখলো না – যে সূত্রকে হকিং সাহেব স্বয়ম্ভূ বানিয়ে নিলেন সেগুলো কোথা থেকে এলো? সূত্র হলো কিছু নিয়ম, কিছু প্যাটার্ন, যা অন্য কোনো বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সত্তা নির্ধারণ করেন। যেহেতু কোনো এক কোম্পানি ঠিকঠাক নিয়মমত চলছে, তাই এটি শূন্য থেকে নিজেকে সৃষ্টি করতে পারে – এমন কথা কোনো পাগলও বলবে কি? হকিং-এর এমন কথার মানে হলো, মহাবিশ্বে এমন মাপা সূচনা পদার্থবিজ্ঞানীদের সূত্রই নির্ধারণ করে দিয়েছে। বাহ বাহ! এই, ওয়েট আ মিনিট? তারমানে বিগ ব্যাং এর আগেও সূত্র ছিলো!! কিন্তু বিগ ব্যাং এর আগে তো টাইম-স্পেস-এনার্জি-ল কিচ্ছু ছিলো না। তো সূত্র এলো কোথা থেকে? পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলোর জন্মই তো হয়েছে বিগ ব্যাং এর পর! এই সেরেছে! হকিং সাহেব খোদার জায়গায় সূত্রকে বসিয়ে দিলেন দেখছি! হকিং এর এমন আজগুবি দাবী সম্পর্কে সেক্যুলার তাত্ত্বিক পদার্থবিদ পল ডেইভিস বলেন :
“হকিংয়ের দাবীকৃত এই সূত্র হলো মূলত ব্যাখ্যাহীন ও উর্ধ্বে অবস্থানকারী স্রষ্টার সমতূল্য!” [3]
বিজ্ঞান পদ্ধতিগত প্রকৃতিবাদের দর্শন নিয়ে তার গবেষণা শুরু করে। তাই বস্তুজগতের উর্ধ্বে যা, তা বিজ্ঞানের নাগালের বাইরে। ফুটবলের নিয়ম দেখে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, এই খেলার কোনো ডিজাইনার আছে, স্রষ্টা আছে। কারণ আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, নিয়ম বা সুত্র হাওয়া থেকে ভেসে আসে না, এর নির্মাতা লাগে। তো মহাবিশ্বের সূত্রের নির্মাতা কে? কমন সেন্স বলে, কোনো কসমিক ডিজাইনার, মহাজাগতিক স্রষ্টা।
কিন্তু প্রকৃতিবাদী বিজ্ঞান তা বলতে পারে না, কারণ সেই স্রষ্টা বস্তুজগতের বাইরে। অপ্রমাণিত ডার্ক এনার্জির ধারণা প্রস্তাবনার জন্য ২০১১ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়া টিমের একজন, প্রফেসর অ্যালেক্সে ফিলিপ্পেনকো এক সাক্ষাতকারে বলেন :
“… আমি মহাবিশ্বকে একজন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করতে চাই … কোনো অতিমানবিক বা স্বকীয় স্রষ্টা আছেন কিনা বা এই মহাবিশ্বের কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা সে বিষয়ে আমি কিছু বলব না – এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বিজ্ঞানীরা দিতে পারে না…।” [4]
তাহলে হকিং ও তার ভক্তরা এমন গুবলেট কেন পাকিয়ে ফেলল? কারণটা একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর মুখেই শুনুন:
“আমি স্টিফেন হকিংকে খুব ভালো করে চিনি। দর্শনে তার জ্ঞান নিতান্তই অল্প, আর ধর্ম নিয়ে সে কিছু জানে না বললেই চলে। তাই ‘সূত্র আছে বলে স্রষ্টার দরকার নেই’ – তার এমন কথায় কান দেওয়া ঠিক না।” [5]
আসলে মুক্তমনা সম্প্রদায় মিডিয়ার ছলচাতুরির শিকার হয়েছে। সেলেব্রেটি কালচারে ডুবে থাকায় সহজেই এদের বোকা বানানো গেছে। সাধারণ মানুষকে একজন বিখ্যাত পদার্থবিদের নাম জিজ্ঞেস করলে প্রায় সবাই হকিং -এর নাম বলবে। আইনস্টাইনের পরে নাকি হকিংই সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানী! যেমন আনন্দবাজারের উচ্চাভিলাষী কথা অনুযায়ী, “সত্যি, আলবার্ট আইনস্টাইনের পরে বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ সেলেব বা আইকন তো তিনিই।” অবস্থা এতই খারাপ যে পদার্থবিদ্যার এক অধ্যাপক তো ওনাকে বিজ্ঞানের ঈশ্বর বানিয়ে ফেলেছেন!!
কিন্তু স্বয়ং হকিংকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো—লোকে বলে আইনস্টাইনের পরে নাকি আপনিই সবচেয়ে প্রতিভাধর বিজ্ঞানী? হকিং বিতৃষ্ণার সুরে টাইম ম্যাগাজিনকে বলেছিলেন, “Rubbish, It’s mere media hype.” অর্থাৎ রাবিশ! এগুলা স্রেফ মিডিয়ার প্রতারণা! হকিং-এর কথার সাথে তার সহকর্মীরাও একমত। ১৯৯৯ সালে ১৩০ জন প্রথম সারির পদার্থবিদকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো — আপনার মতে পদার্থবিদ্যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান যে রেখেছে তাকে ভোট দিন। বেচারা হকিং পেয়েছিলেন মাত্র ১ ভোট !!!
নাস্তিকতায় বিশ্বাসী হওয়ার কারণে হকিং সাহেব স্রষ্টার জায়গায় সূত্রকে বসিয়েছেন, আর তার কথা শুনে বাচবিচার না করেই মুক্তমনা সম্প্রদায় যারপরনাই আনন্দিত। এদের জন্য কেমন সমবেদনা হবে বন্ধুরা?
লেখাটি বেস্ট সেলার গ্রন্থ ‘অবিশ্বাসী কাঠগড়ায়’ থেকে গৃহিত ও পরিমার্জিত।
লেখকের নিজস্ব ওয়েবসাইটের লিঙ্কঃ
https://rafanofficial.wordpress.com/2019/12/12/god-of-stephen-hawking/
তথ্যসূত্রঃ
[1] STEPHEN HAWKING, A BRIEF HISTORY OF TIME; P. 127 (BANTHAM BOOKS, 1988)
[2] ADAM GABBATT, STEPHEN HAWKING SAYS UNIVERSE NOT CREATED BY GOD; THE GUARDIAN
[3] PAUL DAVIES, STEPHEN HAWKING’S BIG BANG GAPS. THE GUARDIAN
[4] QUOTED IN RT NEWS, ‘SCIENTISTS ONLY UNDERSTAND 4% OF UNIVERSE’
[5] রয়াল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ও ব্রিটেনের শীর্ষ বিজ্ঞানী (নিধর্মী) মার্টিন রিস। THE INDEPENDENT